একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জল দিন।বর্তমানে এটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়।একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ গৌরবোজ্জল স্মৃতিবিজড়িত দিন।পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে বাঙালিরা বাংলা ভাষার সমমর্যাদার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৫২ সালের এই দিনে (৮ই ফাল্গুন, ১৩৫৮) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেড়িয়ে এলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। এ মর্মান্তিক ঘটনায় রফিক, জব্বার, শফিউল,সালাম ও বরকতসহ আরো অনেকে শহিদ হন।এ আন্দোলনের ফলে শাসকগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। তাই বাঙালিরা এ দিনটিকে শহিদ দিবস হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে।
বিশ্বের সকল জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপনের ঘোষণা প্রদান করে। ২১শে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করার আগে, দিনটিকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে দাবি শোনা যায়। তবে এ বিষয়ে প্রথম সফল উদ্যোক্তা হলেন কানাডার বহুভাষিক ও বহুজাতিক মাতৃভাষা-প্রেমিকগোষ্ঠী। তাদের মধ্যে অন্যতম দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ১৯৯৮ সালের ২৯ শে মার্চ। সেখানে তারা বলেন যে, বাঙালিরা তাদের মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সেটা ছিল তাদের ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।কাজেই মাতৃভাষা দিবসের দাবিটি খুবই ন্যায়সংগত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং এ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশ সমূহের যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের উত্থাপিত প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ২১ শে অক্টোবর বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫ তম অধিবেশনে “প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে জাতিসংঘ” মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মে মাসের ১১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের তথ্য বিষয়ক কমিটিতে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়।
১৯৫২ সাল থেকে প্রতিবছর এ দিনটি জাতীয় শহীদ দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় ২১শে ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা এক মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতি এবং পরে একাদিক্রমে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষকবৃন্দ, ঢাকাস্থ বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন এবং সর্বস্তরের জনগণ নগ্ন পায়ে হেঁটে শহীদ মিনারে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন।এ সময় আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত ও আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গানের করুণ সুর বাজতে থাকে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষিত হয়। এদিন শহীদ দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে সরকারি ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। দেশের সংবাদপত্রগুলিও বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে।