কিংবদন্তী বাঙালি শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

  • ধুপ চিরদিন নিরবে জ্বলে যায়
    প্রতিদান সেকি পায়….?
  • কিংবদন্তী বাঙালি শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা….
    সংগীতকে ভালোবেসে এর পেছনে ব্যয় করেছেন পুরো জীবন। গান গেয়েছেন একাধিক ভাষায়। বাংলা গানের সোনালী যুগের কথা উঠলে প্রথমেই যাদের সুরেলা কণ্ঠের কথা মনে পড়ে তাদের অন্যতম সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
    মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) রাত ৮টার দিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রবাদপ্রতিম এ সংগীত শিল্পী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর।
    সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়াতে ৪ অক্টোবর ১৯৩১ সালে রেলের কর্মকর্তা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং হেমপ্রভা দেবীর ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন। তার পিতামহ একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং পরিবারটি ১৯১১ সাল থেকে ঢাকুরিয়াতে বসবাস করতেন।তার সংগীত শিক্ষার মূল কান্ডারী ছিলেন দাদা রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। ১৯৪৫ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রথম গান রেকর্ড করেন তিনি।সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ১২ বছর বয়স থেকে গান গাইছেন। সংগীতের পেছনে জীবনের ৭৫ বছর উৎসর্গ করে দিয়েছেন।
    সন্ধ্যা, পণ্ডিত সন্তোষ কুমার বসু, অধ্যাপক এ টি ক্যানন এবং অধ্যাপক চিন্ময় লাহিড়ীর নিকট তার সঙ্গীত প্রশিক্ষণ শুরু করেন। তবে তার গুরু ছিলেন উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান, তার পুত্র উস্তাদ মুনাওয়ার আলী খান, যার অধীনে তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত আয়ত্ত করেছিলেন। মনোরমা শর্মা অনুসারে, ” নেপথ্য গানের উজ্জ্বল গৌরব অর্জনের পরেও একজন শাস্ত্রীয় গায়ক হিসাবে সন্ধ্যা, তার জনপ্রিয়তা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন।”
    শ্রোতাদের মনে যার কণ্ঠের ধ্বনি আজও একইরকম সতেজ ও সজীব। শুধু বাংলা গানই নয়, হিন্দি ছবির গানেও নিজের পায়ের তলার জমি শক্ত করেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
    ১৯৪৮ সালে প্রথমবার প্লেব্যাক করেন, সিনেমার নাম ‘অঞ্জনগড়’। ওই বছর তার কণ্ঠে আরও তিনটি গান প্রকাশিত হয়। যার সুবাদে গায়িকা হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যান।যদিও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রশিক্ষিত, তার বেশিরভাগ কাজ বাংলা আধুনিক গানগুলিতে।
    ১৯৫০ সালে মুম্বাই পাড়ি দিয়েছিলেন বাংলা বেসিক আধুনিক গানের সম্রাজ্ঞী সন্ধ্যা।তিনি ১৭টি হিন্দি চলচ্চিত্রে একজন নেপথ্য গায়িকা হিসেবে গান গেয়েছিলেন। শচীন দেব বর্মনের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল তার বম্বে সফর। তবে সেখানে সন্ধ্যার প্রথম প্লেব্যাক করিয়েছেন সুরকার অনিল বিশ্বাস। ১৯৫০সালে তারানা চলচ্চিত্রে একটি গান দিয়ে মুম্বাইতে হিন্দি গান গাওয়া শুরু করেন তিনি। ব্যক্তিগত কারণে ১৯৫২ সালে তিনি তার কলকাতা শহরের বাড়িতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি বাঙালী কবি শ্যামল গুপ্তকে বিয়ে করেন। শ্যামল তার অনেক গানের জন্য কথা লিখে গিয়েছিলেন।
    তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি ছিল হেমন্ত মুখার্জীর সাথে, যার সাথে প্রাথমিকভাবে বাঙালি চলচ্চিত্রগুলির জন্য নেপথ্য গায়িকা হিসাবে তিনি বেশ কয়েকটি গান গেয়েছিলেন। হেমন্ত ও সন্ধ্যা বাংলার মহানায়ক উত্তম কুমার এবং তার অসংখ্য নায়িকা জোড়াগুলির নেপথ্য কণ্ঠস্বর হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন, বিশেষত অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের কণ্ঠে। হেমন্ত মুখার্জির রচনা ছাড়াও রবিন চট্টোপাধ্যায় ও নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে তিনি অনেক কাজ করেন।একজন সঙ্গীত শিল্পী হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও পরোক্ষভাবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচতে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে আগত লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুদের জন্য তিনি ভারতীয় বাঙালি শিল্পীদের সঙ্গে গণ আন্দোলনে যোগ দেন এবং তাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করেন। তিনি বাংলাদেশী সংগীতশিল্পী সমর দাস যিনি বাংলাদেশে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন তার সাহায্যার্থে বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান রেকর্ড করেন। কারাগারে বন্দী নতুন বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির উপলক্ষে তার গাওয়া ‘বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে’ গানটি মুক্তি পায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারির উদ্‌যাপন উপলক্ষে ঢাকায় পল্টন ময়দানের একটি উন্মুক্ত কনসার্টে অনুষ্ঠান করা তিনি অন্যতম প্রথম বিদেশি শিল্পী।১৯৭১ সালে ‘জয়জয়ন্তী’ ও ‘নিশিপদ্ম’ ছবিতে গান গেয়ে শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন সন্ধ্যা। এ ছাড়া ২০১১ সালে রাজ্য সরকার তাকে ‘বঙ্গবিভূষণ’ উপাধিতে সম্মানিত করে।২০২২ সালে তাকে পদ্ম শ্রী উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

Related Blogs

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *